ধর্ম ডেস্ক॥ লাইলাতুল কদর আরবী শব্দ যার অর্থ হলো বরকতময়, সম্মানিত বা মহামান্বিত ফারসি ভাষায় একে শবে কদর বলা হয়। এই রজনীতে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সারারাত নফল নামাজ, কোরাআন ও হাদীসের আলোকে জিকির, কবর জিয়ারত ও নিজের কৃত গুনাহের জন্য মাফ চেয়ে থাকে।
লাইলাতুল কদর বা শবে কদর এর গুরুত্ব ও ফজিলত : পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিস দ্বারা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘শবেবরাত’ নিয়ে এবং শবেবরাতের হাদিসগুলোর বর্ণনা নিয়ে হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ফকিহদের মধ্যে যে সংশয় রয়েছে, লাইলাতুল কদরের ব্যাপারে তার কোনোই অবকাশ নেই। পবিত্র কুরআন, নির্ভরযোগ্য হাদিস এবং রাসূলুল্লাহ সা:-এর লাইলাতুল কদরের জন্য গৃহীত কর্মতৎপরতা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ সম্মানিত রজনীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি কুরআনকে কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো, কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাস থেকেও উত্তম কল্যাণময়।’ সূরা আল্ কদর (১-৩)। এ রাতটি কোন মাসে? এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘রমজান এমন মাস, যাতে কুরআন নাজিল হয়েছে।’ (বাকারা-১৮৫)।
এ রাতটি রমজানের কোন তারিখে? রাসূলুল্লাহ সা: একটি রহস্যময় কারণে তারিখটি সুনির্দিষ্ট করেননি। ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম আহমদ ও ইমাম তিরমিজি কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত আয়েশা রা: বর্ণনা করেছেন, নবী করিম সা: বলেছেন, ‘কদরের রাতকে রমজানের শেষ দশ রাতের কোনো বেজোড় রাতে খোঁজ করো।’
হজরত আবু বকর রা:, ও হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত হাদিস থেকেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। অবশ্য কোনো কোনো ইসলামী মনীষী নিজস্ব ইজতিহাদ, গবেষণা, গাণিতিক বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে রমজানের ২৭ তারিখের রাতে (অর্থাৎ ২৬ রোজার দিবাগত রাতে) শবেকদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা: এটাকে সুনির্দিষ্ট করেননি বরং কষ্ট করে খুঁজে নিতে বলেছেন। মহান আল্লাহ চান বান্দাহ কয়েক রাত ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করে এ মহামূল্যবান রাতের সন্ধান পাক।
এ রাতের আরেকটি গুরুত্ব হলোÑ এ পবিত্র রাতেই কুরআন নাজিল হয়েছে। আর এ কুরআনের সাথেই মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। এ জন্য কদরের আরেকটি অর্থ হলো ভাগ্য। তা হলে লাইলাতুল কদরের অর্থ হয় ভাগ্যরজনী। যে মানুষ, যে সমাজ, যে জাতি কুরআনকে বাস্তব জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করবে, তারা পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে সম্মানীত হবেন। এ রাতে নাজিলকৃত কুরআনকে যারা অবহেলা করবে, তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিপ্তি হবে। এ রাতেই মানবকল্যাণে আল্লাহ মানুষের জন্য চূড়ান্তু সিদ্ধান্ত ফেরেশতাদের জানান। আল্লাহ বলেন, ‘এ রাতে প্রত্যেকটি ব্যাপারে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুদৃঢ় ফায়সালা জারি করা হয়।’ (সূরা দুখান-৪)
মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘ফেরেশতারা ও রুহ (জিব্রাইল আ:) এ রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হয়, সে রাত পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তারÑ ফজর উদয় হওয়া পর্যন্তু।’ (সূরা আল-কদর -৪-৫)।
লাইলাতুল কদরের ফজিলত : এ রাতটি হাজার মাস থেকে উত্তম- কল্যাণময় (কুরআন)। এ রাতেই পবিত্র কুরআন নাজিল করা হয়েছে (কুরআন)। এ রাতে ফেরেশতা নাজিল হয় এবং আবেদ বান্দাহদের অবস্থা পর্যবেণ করেন। ফজর পর্যন্ত এ রাতে পুরাপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার (কুরআন), এ রাতে প্রত্যেকটি ব্যাপারে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুদৃঢ় ফায়সালা জারি করা হয় (কুরাআন)। এ রাতে ইবাদতে মশগুল বান্দাদের জন্য অবতরণকৃত ফেরেশতারা দোয়া করেন (হাদিস)।
গুনাহ মাফ : ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান সহকারে ও আল্লাহর নিকট থেকে বড় শুভফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। (বুখারি-মুসলিম)। এ রাতে কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না (ইবনে মাজাহ-মিশকাত)।
কিয়ামুল লাইল : ‘কিয়ামুল লাইল’ অর্থ হলো রাত্রী জাগরণ। মহান আল্লাহর জন্য আরামের ঘুম স্বেচ্ছায় হারাম করে রাত জেগে ইবাদত করা আল্লাহর প্রিয় বান্দাহদের একটি গুণ। মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাহদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবেÑ ‘তারা রাত্রি যাপন করে রবের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে’ (সূরা-ফুরকান-৬৪)।
‘তাদের পার্শ¦দেশ বিছানা থেকে পৃথক থাকে (অর্থাৎ তারা শয্যা গ্রহণ করে না; বরং এবাদতে মশগুল থাকে)। তারা (গজবের) ভয়ে এবং (রহমতের ) আশায় তাদের রবকে ডাকতে থাকে এবং আমি যা দিয়েছি তা থেকে দান করে থাকে। কেউ জানে না। তাদের আমালের পুরস্কারস্বরূপ (আখিরাতে) তাদের জন্য কী জিনিস গোপনে রাখা হয়েছে’ সূরা-সিজদা-১৬-১৭)।
আল্লাহর প্রিয় বান্দারা গোটা জীবনটাই এভাবে কাটান। আমাদের সে জীবনে প্রবেশ করতে হলে দরকার অধ্যবসায়। পবিত্র রমজান বিশেষ করে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা আমাদের ঈপ্সিত ল্েয পৌঁছতে সাহায্য করবে।
এ রাতে আমাদের করণীয়
কুরআন অধ্যয়ন : এ রাতে পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে। মানব জতির এ বিরাট নিয়ামতের কারণেই এ রাতের এত মর্যাদা ও ফজিলত। এ কুরআনকে ধারণ করলেই মানুষ সম্মানিত হবে, দেশ ও জাতি মর্যাদাবান হবে; গোটা জাতির ভাগ্য বদলে যাবে। কাজেই এ রাতে অর্থ বুঝে কুরআন পড়তে হবে। কুরআনের শিাকে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করতে হবে। বাছাইকৃত কিছু আয়াত এ রাতে মুখস্থও করা যেতে পারে। যাদের কুরআনের ওপর প্রয়োজনীয় জ্ঞান রয়েছে তারা এ রাতে একটি দারসও প্রস্তুত করতে পারেন। কুরআনের এ গভীর অধ্যয়ন আমাদের সৌভগ্যের দ্বার খুলে দেবে।
নফল নামাজ : ন্যূনতম ১২ রাকাত থেকে যত সম্ভব পড়া যেতে পারে। এ জন্য সাধারণ সুন্নতের নিয়মে দুই রাকাত নফল পড়ছি। এ নিয়তে নামাজ শুরু করে শেষ করতে হবে। এ জন্য সূরা ফাতেহার সাথে আপনার জানা যেকোনো সূরা মিলাইলেই চলবে। এ ছাড়া সালাতুল তওবা, সালাতুল হাজত, সালাতুল তাসবিহ নামাজও আপনি পড়তে পারেন। রাতের শেষভাগে কমপে আট রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ার চেষ্টা আমরা অবশ্যই করব। কারণ এ নামাজ সর্বশ্রেষ্ঠ নফল নামাজ। আর রাতের এ অংশে দোয়া কবুল হয়।
জিকির ও দোয়া : হাদিসে যে দোয়া ও জিকিরের অধিক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে সেগুলো থেকে কয়েকটি নির্বাচিত করে অর্থ বুঝে বার বার পড়া যেতে পারে। ইস্তেগফার (মা প্রার্থনা) ও দরুদ আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। কমপে ১০০ বার ইস্তেগফার ও ১০০ বার দরুদ পড়া যেতে পারে। হজরত আয়েশা রা: বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, যদি কোনো প্রকারে আমি জানতে পারি রাতটি লাইলাতুল কদর, তাহলে কী দোয়া করব? জবাবে নবী সা: বলেন, এ দোয়া পড়বেÑ ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুব্বুন কারিমুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।’ আয় আল্লাহ তুমি বড়ই মাফ করনেওয়ালা এবং বড়ই অনুগ্রহশীল। মাফ করে দেয়াই তুমি পছন্দ করো। অতএব তুমি আমাদের গুনাহগুলো মা করে দাও।
আত্মসমালোচনা : আত্মসমালোচনা অর্থ আত্মবিচার। অর্থাৎ আপনি নিজেই নিজের পর্যালোচনা করুন। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোতে আল্লাহর কতগুলো হুকুম অমান্য করেছেন, আল্লাহর ফরজ ও ওয়াজিবগুলো কতটা পালন করেছেন, ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় কী কী বড় গুনাহ আপনি করে ফেলেছেন, আল্লাহর গোলাম হিসেবে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় আপনি কতটুকু ভূমিকা রেখেছেনÑ এগুলো ভাবুন, যা কিছু ভালো করেছেন তার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন, আর যা হয়নি তার জন্য আল্লাহর ভয় মনে পয়দা করুন, সত্যিকার তওবা করুন। এ রাতে নীরবে-নিভৃতে কিছুটা সময় এ আত্মসমালোচনা করুন, দেখবেন আপনি সঠিক পথ খুঁজে পাবেন। আত্মসমালোচনা আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তুলবে। আত্মসমালোচনা আত্মশুদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদার লোকেরা, আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো এবং প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামীকালের জন্য (পরকাল) সে কী প্রেরণ করেছে তা চিন্তা করা’(সূরা হাশর-১৮)।
মুনাজাত : মুনাজাতের মাধ্যমে বান্দার বন্দেগি ও আল্লাহর রবুবিয়াতের প্রকাশ ঘটে। বান্দাহ তার প্রভুর কাছে চায়। প্রভু এতে ভীষণ খুশি হন। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি এতটাই অনুগ্রহশীল যে, তিনি তাঁর কাছে না চাইলে অসন্তুষ্ট হন। ‘যে আল্লাহর কাছে কিছু চায় না আল্লাহ তার ওপর রাগ করেন।’ (তিরমিজি)। ‘দোয়া ইবাদতের মূল’- (আল-হাদিস)। ‘যার জন্য দোয়ার দরজা খোলা তার জন্য রহমতের দরজাই খোলা রয়েছে’- (তিরমিজি)। কাজেই আমরা কায়েমনোবাক্যে আল্লাহর দারবারে মুনাজাত করব, মা চাইব, রহমত চাইব, জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাইব। মনের আবেগ নিয়ে চাইব। চোখের পানি ফেলে চাইব।
আল্লাহ আমাদের খালি হাতে ফেরাবেন না ইনশাআল্লাহ। রাসূল সা:-এর বাণী আশার আলো জ্বেলেছে হৃদয়ে। রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমাদের পরোয়ারদিগার লজ্জাশীল ও দাতা; লজ্জাবোধ করেন যখন তাঁর বান্দা তার কাছে দুই হাত ওঠায় তখন তা খালি ফিরিয়ে দিতে’- (তিরমিজি, আবু দাউদ, বায়হাকি- দাওয়াতে কবির)।
উপরিউক্ত আমলের মাধ্যমে আমরা এ পবিত্র রাতগুলো কাটাতে পারি। লাইলাতুল কদর পাবার আশা নিয়ে নিষ্ঠার সাথে অনুসন্ধান করলে আল্লাহ আমাদের বঞ্চিত করবেন না ইনশাআল্লাহ। অবশ্য নফল ইবাদত নীরবে নিভৃতে ঘরে আদায় করাই মাসনুন। এতে আমাদের ইবাদত রিয়া (প্রদর্শন ইচ্ছা) দোষে দুষ্ট হওয়ার হাত থেকে রা পাবে।
Post Top Ad
Your Ad Spot
Sunday, June 18, 2017
লাইলাতুল কদর বা শবে কদরের নামাজ পড়ার নিয়ম
Tags
Islamic Story amp; Hadis#
Share This
About Raihanul Haque
Islamic Story amp; Hadis
Labels:
Islamic Story amp; Hadis
Post Top Ad
Your Ad Spot
Author Details
----